গর্ভধারণ এবং ওজন সমস্যা

গর্ভধারণ মহিলাদের জীবনে একটি স্বাভাবিক প্রকৃয়া। ২২ থেকে ৩২ বছর বয়স পর্যন্ত গর্ভধারণের উপযুক্ত সময়। গর্ভধারণের প্রস্তুতির সময় একজন মহিলাকে নিম্নের অবস্থাগুলির দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
বয়স
শারীরিক অবস্থা
মানসিক অবস্থা
রক্তের চাপ
রক্তে চিনির অবস্থা
রক্তে ক্যালসিয়াম ও আয়রণের পরিমাণ
স্বামী-স্ত্রী উভয়ের হরমোনের অবস্থা
সংক্রামক রোগ
পারিবারিক অবস্থা
স্বামীর লিভিং ঋনের সংখ্যা

অনেক সময় দেখা যায় যে, উপরোক্ত সবকিছু স্বাভাবিক অবস্থায় থাকা সত্ত্বেও একজন মহিলা গর্ভধারণে অপারগ। এর মূল কারণ কি? ডাক্তার পরীক্ষা নীরিক্ষা করে বলেন আপনার কোন সমস্যা নেই, শুধু আপনার শারীরিক ওজনই আপনার একমাত্র সমস্যা। ওজন কমান, ওজন কমালে গর্ভধারণের সম্ভাবনা অনেকগুণ বেড়ে যায় এবং এটি পরিক্ষিত। শুধুমাত্র শারীরের অতিরিক্ত ওজন কমিয়ে গর্ভধারণ করেছেন এমন গর্ভবতী মায়ের সংখ্যা লক্ষণীয়। গবেষণার ফলাফল ৬৭%। ওজন বৃদ্ধির ফলে যে সমস্ত সমস্যার সম্ভাবনা বাড়ে তা হলো-


মাসিকের সমস্যা
পলি সিষ্টিক ওভারী
বন্ধ্যাত্ব বা গর্ভধারণের অক্ষমতা
ডায়াবেটিস
উচ্চরক্তচাপ
হূদরোগ
কিডনি অকেজো
হরমোনের অসমতা
পায়ের ব্যথা
কোমড়ের ব্যথা
অস্টিওআথ্রাইটিস
আথ্রাইটিস
পিত্তথলির রোগ
ভেরিকোষ ভেইন
ফ্যাটি লিভার
কর্মক্ষমতা কমে যাওয়া
গর্ভপাত
ব্রেস্ট ক্যান্সার, কোলন ক্যান্সার, প্রস্টেট ক্যান্সার
ডিপ্রেশন
ডিসলিপিডেমিয়া
স্লিপ অ্যাপনিয়া
শ্বাসকষ্ট

অতিরিক্ত ওজন (ওবেসিটি) কে বলা হয় উপরোক্ত রোগ গুলোর সহযোগী রোগ। গর্ভাবস্থায় একজন মাকে অবশ্যই উপরোক্ত রোগ মুক্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে। মাকে মনে রাখতে হবে শুধু গর্ভধারণ করলেই চলবে না তাকে একটি সুস্থ সন্তান প্রসবের সর্বাত্বক চেষ্টা চালাতে হবে। এক্ষেত্রে বলা যায়, গর্ভধারণ ও সুস্থ্য সন্তান প্রসবের পূর্ব শর্ত শরীরের আদর্শ ওজন, আদর্শ ওজন সহজে গর্ভধারণের সহায়ক ও উপরোক্ত রোগ প্রতিরোধের মাধ্যমে বিকলাংক শিশু জন্মদান অনেকাংশে কমে আসবে। কারণ অসুস্থ্য মাকে গর্ভাবস্থায় অনেক ধরণের ওষুধ গ্রহণ করতে হয়। যেমন- এন্টিহাইপার টেনসিভ, এন্টিডায়াবেটিক, স্টেরয়েড, ইনহেলার, পেইনকিলার এসমস্ত ওষুধ গর্ভাবস্থ শিশুর উপর নেগেটিভ প্রভাব ফেলে। তাই ওজন স্বাভাবিক রেখে, রোগ প্রতিরোধের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া, যে কোন সময় যে কোন ওষুধ গ্রহণের প্রবণতা থেকে বিরত থাকতে হবে।

সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ওজনের বিরূপ প্রভাব:
অনিয়মিত মাসিক
ডিম্ব পরস্ফুিটণের হার কম
পলি সিষ্টিক ওভারী সিনড্রম
শরীরে হরমোনের পরিবর্তন
সেক্স হরমোন নি:স্বরণ ও কার্যকারিতার পরিবর্তন।

অতিরিক্ত ওজনের কারণে যারা গর্ভধারণ করতে পারছেন না, তাদেরকে ডাক্তার পরামর্শ দিচ্ছেন ওজন কমানোর। কারণ অতিরিক্ত ওজন কমিয়ে ফেললে গর্ভধারণের সম্ভাবনা বাড়ে। গবেষণায় দেখা যায় ১০-১৫ কেজি ওজন কমালে যাদের অতিরিক্ত ওজন তাদের ক্ষেত্রে ৮৯.৬% > নিয়মিত ভাবে ডিম্ব পরস্ফুিটন হচ্ছে, ৭৭.৬% গর্ভধারণ হয়েছে, ৬৭% সন্তান জন্মদান করেছেন। অতএব অতিরিক্ত ওজন কমাতে পারলে যে গর্ভধারণের সম্ভাবনা বাড়ে তা বৈজ্ঞানিক গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত। তাই গর্ভধারণের ইচ্ছুক মহিলার শরীরের ওজন স্বাভাবিক থাকা আবশ্যক। অতিরিক্ত ওজন নিয়ে গর্ভধারণ করলেও বার বার গর্ভপাত ঘটার ঘটনাও অনেক।

ওজন কি করে কমাবেন:
আপনি হয়তো গর্ভধারণের আশায় অনেক কিছু করছেন। যেমন-ভাত খাচ্ছেন না, রুটি খাচ্ছেন না, হাটছেন, কত টাকা পয়সা খরচ করছেন। ওজন কমানোর ওষুধ খাচ্ছেন। লেজার করছেন। লাইপোসেকশন করছেন, অনেকে বুদ্ধি দিলেন যে, তলপেটের চর্বি কমাও, সেটাও করালেন। মোটা অংকের টাকা খরচ করে লাইপোলাইসিসের ম াধ্যমে আপনার তলপেটের চর্বি ২-৩ ইঞ্চি কমলেই কি আপনার গর্ভধারণ হবে। আপনার হয়তো ১০/২০/৩০ কেজি ওজন কমাতে হবে। পুরোপুরি ভাবে আপনার জরায়ু, ডিম্বাশয়, ইত্যাদি প্রস্তুত হতে হবে। তবেই গর্ভধারণের সম্ভাবণা বাড়বে। অনেক কিছু করা হলো কিন্তু ওজনও কমলো না। গর্ভধারণও হলো না। তখন কি করবেন? নিজে জেগে উঠুন। নিজের সাথে প্রতিজ্ঞা করুন। অকার্যকর পদ্ধতি পরিহার করুন। এতদিন যা করেছেন তা ত্যাগ করুন। ওজন কমানোর ওষুধ খাবেন না। ওজন কমানোর দেশী বিদেশী দামী কমদামী ওষুধ কোনটাই স্থায়ীভাবে ওজন কমাতে সক্ষম হয়নি। তার ওপর এগুলো শরীরে নানা রকম ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে, যেমন- লিভার, কিডনি, ইত্যাদি। আশে পাশের ভাবী বা বান্ধবীদের কথায় এটা সেটা খাওয়া শুরু করবেন না। কারণ গর্ভধারণের বাঁধা দানকারী খাদ্যগুলো হয়তো আপনি গ্রহণ করছেন। অর্থাত্ না বুঝে না শুনে ডায়েট করবেন না। গর্ভধারণের ইচ্ছুক মহিলারা ওজন কমানোর জন্য দড়ি লাফাবেন না, মেশিনের হাঁটবেন না, মেশিনে দৌড়াবেন না, কাচা পেঁপেঁ খাবেন না, টমেটো খাবেন না, আনারস খাবেন না, সয়া মিল্ক খাবেন না, পেটের মধ্যে তাপ জাতীয় কোন মাসাজ বা মালিশ করাবেন না। বিশেষজ্ঞদের মতে লেজার বা লাইপোসেকশনের মাধ্যমে স্থূলতার চিকিত্সা করা হয় না। এগুলো স্বীকৃত চিকিত্সা পদ্ধতি নয়। (চলবে)

ওজনকমানোর সঠিক ও কার্যকরী পদক্ষেপ: সঠিক পদক্ষেপ হলো দু’টি। এক: ওজন কমানোর জন্য নিয়মিত ক্যালরি ও সুষম খাবার গ্রহণ করা। অর্থাত্ ওয়েট রিডিউসিং ডায়েট চার্ট মেনে চলা। দুই:প্রতিদিন নিয়ম করে ৪০ মি: থেকে ৬০ মি: খোলা জায়গায় হাঁটা। কোন মেশনি নয়। ওজন কমাতে নিয়মিত হাঁটার কোন বিকল্প নেই। উপরোক্ত দুই পদক্ষেপ ছাড়া ওজন কমানোর সঠিক কোন পদ্ধতি নেই। এই দু’টি পদক্ষেপ আপনাকে ওজন কমাতে শতভাগ নিশ্চয়তা দেবে, ইনশাল্লাহ। ডায়েট আপনি আপনার আয়ের সাথে সমতা রেখে সহজলভ্য খাদ্য দ্বারা ওজন কমাতে পারেন ও সহজেই গর্ভধারণ করতে পারেন। হাঁটাতে কোন খরচ নেই। খরচের হার ০%। উপরোক্ত পদ্ধতি দ্বারা নিজেই ঘরে বসে ১ মাসে ওজন কমাতে পারেন ৪-৫ কেজি। এতে গর্ভধারণের পথ সূগম হবে।

এই দুই পদক্ষেপ মেনে চলতে আপনার যা দরকার: প্রচন্ড ইচ্ছা শক্তি, নিজের সাথে প্রতিজ্ঞা, নিজের দায়িত্ব নিজে নেয়া। সারাদিনের ২৪ ঘন্টার মধ্যে ৪০ মিনিট হাঁটার জন্য সময় বের করা। সারা জীবন নয় প্রথমে মাত্র ১ মাসের জন্য নিয়ম মেনে চলা, ফলাফল পেলে আপনি সিদ্ধান্ত নিন পরের মাসে আরো ৪-৫ কেজি ওজন কমাবেন কিনা। এক মাসে জন্য চিনি ছেড়ে দিন, তেল গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দিন প্রতিদিন ৫ চা চামচ তেল এর বেশি নয়। ভাজা ও মিষ্ট খাবার একেবারেই খাবেন না। ডায়েট করবেন, বর্তমানে যা খাচ্ছেন তার তিন ভাগের এক ভাগ খাবার খাবেন। সবকিছুই খাবেন কিন্তু পরিমাণের কম। মাত্র এক মাসের জন্য আপনার পরীক্ষায় আপনাকে উত্তির্ণ হতে হবে, চেষ্টা করুন, যেমন বর্তমানে আপনি ৩টি রুটি খাচ্ছেন এখন থেকে ১টি রুটি খাবেন, এভাবে সব খাবারের পরিমাণ কমাবেন। খাবার বাদ দেয়া যাবে না। দাওয়াতে যদি খেতেই হয় তবে এক মাসের জন্য না খেলে কি হবে, মনে রাখবেন আপনি গর্ভধারণ করতে চান। আর এই খাদ্য নিয়ন্ত্রণ তো সারা জীবনের জন্য নয়। ওজন কমানো পর্যন্ত। কাছের মানুষের সহযোগীতা নিন।

খাদ্য তালিকা থেকে যা বাদ দিতে হবে: ময়দা, চিনি, বেকারী খাবার, চর্বিযুক্ত মাংস, চিনি, দুধ চা, ফাস্টফুড, অনুষ্ঠানের খাবার, শুকনো খাবার, যেমন- মুড়ি, বিস্কুট, বাদাম, ভাজা, ভূনা ও ঘন খাবার।

খাদ্য তালিকায় যা যোগ করতে হবে: লিগার চা, লেবু চা, গ্রীন টি, বেশি শাক সবজি, (আলু ও কলা নয়) সালাদ, কম চর্বি যুক্ত দুধ, লেবু, সিরকা, লাল আটার রুটি, লাল চালের ভাত, আশযুক্ত খাবার, টকফল, (জাম্বুরা, আমড়া) ডিমের সাদা অংশ, মাছ, মুরগী ও ১০-১২ গ্লাস পানি।

খাদ্যের ৬টি উপাদান:এবার লক্ষ করুন, আপনার খাদ্য তালিকায় খাদ্যের ৬টি উপাদান বিদ্যমান আছে কিনা। যেমন-প্রোটিন, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট, ভিটামিনস, মিনারেলস ও পানি। বর্তমানে খাদ্যশস্য ও খাদ্য তালিকায় সংযুক্ত করার জন্য পুষ্টি বিজ্ঞানীদের ইতিবাচক সম্মতি রয়েছে। একটু লক্ষ করুন, আমাদের বেচে থাকার জন্য যে অবস্থাগুলির ভূমিকা আবশ্যকিয়, অতিরিক্ত ওজন এই সবগুলোকে ধ্বংস করে, যেমন- স্থূলতা। স্থূলতা মানসিক চাপ বাড়ায়, কর্মক্ষমতা কমায়, লেখাপড়ায় অমনোযোগী করে, চাকরিতে বিঘ্ন ঘটায়, বিষন্নতা তৈরী করে, স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের অবণতি ঘটায় অর্থাত্ স্থূলতার কোন ভালো দিক নেই। তবে কেন এই স্থূলতা; এর সমাধান কি; এর চিকিত্সা কি; এর চিকিত্সক কে; এসব বিষয়ে নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনি কি চান। এভাবেই থাকবেন, না ওজন কমাবেন? এ প্রশ্নের উত্তর, ওজন কমানোর জন্য বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নেয়া, অর্থাত্ প্রচন্ড ইচ্ছা শক্তি।

চিকিত্সা: খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও হাঁটা ও চিকিত্সক এসব ক্ষেত্রে ওজন কমানোর চিকিত্সক আপনি নিজে, আপনি যদি আপনাকে সাহায্য না করেন, তবে কে আপনাকে সাহায্য করবে, টিচার শুধু ভালো হলে আপনি তো পাশ করতে পারবেন না। আপনাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে সাফল্যের জন্য লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য।

আর নয় অবহেলা:এক মাস নিজে চেষ্টা করুন, নিজের ভালো কে না চায়। আজকের নির্দেশনা আপনার ওজন কমাতে যথেষ্ট এবং আপনি নিজেই যথেষ্ট। এখানে তো কোন ক্ষতিকারক দিক নেই, খরচ নেই, শুধু আপনার আগ্রহ, আপনার ইচ্ছা শক্তি ও আপনার সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।

সতর্কতা: শুধু ওজন কমাতে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করা অপ্রয়োজনীয় অপচয়, তবে আপনার ইচ্ছা, আপনার সিদ্ধান্ত একান্তই ব্যক্তিগত।

শুভকামনা:সঠিক পদ্ধতি মেনে আপনার অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণ করুন। ওজন কমানোর ব্যর্থতা থেকে বের হয়ে আসুন। আল্লাহ আপনার কঠিন কাজ সহজ করে দিক। আপনার গর্ভধারণের ইচ্ছা পূরণ হোক, সফলতার স্লোগান, “নিজের ভাগ্য নিজে গড়ি অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণ করি

0 comments:

Post a Comment

Blog Archive

Recent Posts

Categories

Unordered List

Sample Text

Pages