পেটে পাথর নয় তো



ঢাকা: পেটে ব্যথা, সঙ্গে বুক জ্বালা? অম্লচূর্ণ, পাচন, শিশির পর শিশি হোমিওপ্যাখথি ওষুধ, মুড়ি-মুড়কির মতো অ্যান্টাসিড মায় কেউ কেউ মন্দির বা পীরবাবার জলও খাচ্ছেন দিনের পর দিন। লাভের লাভ কিছু হচ্ছে না, বরং উত্তরোত্তর পেটের ব্যথা বেড়েই যাচ্ছে।

কেন এত ব্যথা? গল ব্লাডারের পাথর নয় তো? গল ব্লাডার বা পিত্তথলিতে পাথর থাকলে তা অপারেশন আজকাল নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। আমাদের দেশে আলট্রাসোনোগ্রাফির ব্যবস্থা যত বাড়ছে ততই বেশি করে পিত্তথলির পাথর ধরা পড়ছে।



পিত্তথলি (গল ব্লাডার) কোথায় থাকে, তার কাজ কী?

পিত্তথলি থাকে লিভারের ঠিক ডানদিকে। এর কাজ হলো লিভার বা যকৃৎ থেকে যে পিত্তরস বের হয়, তাকে ধরে রাখা। পাকস্থলীতে খাদ্য পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে এই পিত্তথলি সঙ্কুচিত হয়। ফলে এই পিত্তরস (Bile) ক্ষুদ্রান্তে (Duodenum) গিয়ে খাদ্যের সঙ্গে মেশে।

পিত্তথলিতে পাথর হয় কেন

বাচ্চা থেকে অল্পবয়সীদের ক্ষেত্রে পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার একটা বড় কারণ হলো থ্যা লাসেমিয়া বা হিমোলাইটিক অ্যানিমিয়া (Haemolytic Anaemia)-এর ফলে রক্তে লোহিত কণিকা বেশি মাত্রায় ভেঙে গিয়ে পিত্তথলিতে পাথর তৈরিতে অংশ নেয়।

মহিলাদের পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা পুরুষদের তুলনায় বেশি। গর্ভাবস্থার পরে বা জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি নিয়মিতভাবে খেলে গল ব্লাডারে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। এর জন্য ইস্ট্রোজেন (Estrogen) হরমোন দায়ী।

গল ব্লাডারে পাথরের উপসর্গ কী

৫০-৬০শতাংশ মানুষের গল ব্লাডারে পাথর নিয়ে কোনো অসুবিধা হয় না। (Asymptomatic) বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই পাথর হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়তে থাকে। কারো কারো সামান্য হজমের গোলমাল অথবা পেটের ওপরের অংশে সামান্য ব্যথা বা যন্ত্রণা অনুভব করা-এগুলিই সাধারণ উপসর্গ।

যদি কোনো কারণে জটিলতা তৈরি হয় সেক্ষেত্রে পুঁজের সংক্রমণ হয় (Acute Cholecystitis) অথবা গ্যাংসগ্রিন বা ফুটো (Perforation) হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে। এই অবস্থায় পেটে অসম্ভব যন্ত্রণা এবং বমি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাঁপুনি দিয়ে জ্বরও আসতে পারে।

পিত্তথলির পাথর থলি থেকে বেরিয়ে এসে পিত্তনালীতে (Bile duct) অবরোধ করতে পারে তখন জনডিস (Obstructive Jaundice) সহ পেটে ব্যথা হতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাথর পিত্তনালীতে বেরিয়ে এসে প্যািনক্রিয়াটাইটিসের মতো মারাত্মক প্রাণহানিকর সমস্যাও সৃষ্টি করতে পারে। প্রসঙ্গত, পিত্তথলিতে ছোট ছোট একাধিক পাথর থাকলে এর সম্ভাবনা বেশি।

ভারতে আর একটি বিষয় খুবই উল্লেখযোগ্য যে, অনেকদিন পিত্তথলিতে পাথর থাকলে ক্যা নসার হওয়ার একটা সম্ভাবনা দেখা দেয়, পশ্চিমের দেশগুলিতে এই সম্ভাবনা খুবই কম। তবে একথাও সত্যি যে, পিত্তথলিতে ক্যাননসার হতে হলে পাথরকে অন্তত ৬-১০বছর থাকতে হবে। দুঃখের বিষয় হলো এই যে, এই ধরনের রোগীর সামান্য হজমের গোলমাল ছাড়া আর বিশেষ কোনো সমস্যা দেখা যায় না। ফলে বেশিরভাগ রোগীই সম্পূর্ণ অন্ধকারে থেকে যান।

পাথর সন্দেহে কী পরীক্ষা করা যেতে পারে

এক্ষেত্রে সাধারণত দুটি পরীক্ষা করা যেতে পারে। প্রথমত, পেটের আলট্রাসোনোগ্রাফি (Ultra Sonography) এবং দ্বিতীয়ত লিভার ফাংকশন টেস্ট (LFT), শেষটি রক্তের একটি পরীক্ষা। জেনে রাখা দরকার যে, যদিও পিত্ততলির পাথর নির্ণয়ে আলট্রাসোনোগ্রাফি প্রায় ১০০% সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে, কিন্তু পিত্তনালীর পাথরের ক্ষেত্রে আলট্রাসোনোগ্রাফি ৭০-৮০% ষেত্রে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে।

এক্ষেত্রে কোনো সন্দেহ থাকলে কিংবা লিভার ফাংকশন টেস্টের রিপোর্ট যদি স্বাভাবিক না থাকে তবেই MRCP (Magnetic Resonance Cholangio Pancreatography) অথবা ERCP (Endoscopic Retrograde Cholangio Pancreatography) পরীক্ষার প্রয়োজন হয়। MRCP হলো এক ধরনের MRI স্ক্যাsন।, যেটি পিত্তনালীর পাথর নির্ণয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ERCP পরীক্ষায় রোগীকে সামান্য ঘুম পাড়িয়ে একটি ভিডিও ক্যাামেরা খাদ্যনালীর মধ্যে দিয়ে পেটে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। সেটি পিত্তনালীর কাছে গিয়ে পিত্তনালীর ভেতরের ছবি তুলে আনে। ERCP-র আরো সুবিধা হলো যে, পিত্তনালীতে যদি পাথর দেখতে পাওয়া যায় তবে তা অনায়াসে বের করে আনা যায়। ERCP-তে জটিলতা হওয়ার সম্ভাবনা ২-৩শতাংশ।

পিত্তথলির পাথরের চিকিৎসা

মোটের ওপর পিত্তথলির পাথরের চিকিৎসাকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়।

প্রথমত, যে সমস্ত রোগীর পাথর থাকার জন্য নানারকম সমস্যাহর সৃষ্টি হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, যাদের সেই রকম কোনো সমস্যাস নেই, (Asymptomatic)। প্রথম গ্রুপটির ক্ষেত্রে (যাঁদের সমস্যা আছে) স্থায়ী সমাধান হলো গল ব্লাডার বা পিত্তথলি অপারেশন করে বাদ দিয়ে দেয়া (Cholecystectomy)। আর দ্বিতীয় গ্রুপে যারা অবস্থান করছেন অর্থাৎ যাদের আপাতত সেই রকম কোনো সমস্যাল নেই তারা একজন অভিজ্ঞ সার্জনের তত্ত্বাবধানে থেকে যেতে পারেন। তবে একথা মনে রাখা দরকার যে, সেই রোগীকে নিয়মিতভাবে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে চলতে হবে এবং কোনো সমস্যার উদ্রেক হলে তখন অপারেশনের কথা ভাবা যেতে পারে।

গর্ভাবস্থার অব্যবহিত পরে পিত্তথলিতে যে পাথর দেখা যায় তার প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ সাধারণত সন্তান প্রসবের ৪-৬ মাসের মধ্যেই নিজে থেক মিলিয়ে যায়। মনে রাখা দরকার যে, এই ঘটনাটি শুধু গর্ভাবস্থার পরেই ঘটে থাকে। কাজেই সেক্ষেত্রে কোনো জটিলতা না থাকলে সন্তান প্রসবের ৬ মাসের মধ্যে গল ব্লাডার অপারেশন না করানোই ভালো। ৬ মাস বাদে একটি আলট্রা সোনোগ্রাফি করার পরেও যদি পিত্তথলিতে পাথর দেখা যায় তখন অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেয়াই ভালো।

গল ব্লাডার বা পিত্তথলির অপারেশন কী কী ভাবে করা যায়

গল স্টোনের চিকিৎসা হলো পাথর সমেত পিত্তথলিটি বাদ দিয়ে দেওয়া। পিত্তথলিটি বাদ দেওয়ার কারণ হলো-একবার পাথর তৈরি হলে পিত্তথলির উপযোগিতা চলে যায়। সেক্ষেত্রে পাথর বের করে দিলেও এই পিত্তথলিতে নতুন করে পাথর তৈরি হতে পারে। ফলে সমস্যা চলতেই থাকে।

পিত্তথলি বাদ দেয়ার পরে অবশ্যই এটি বায়োপসি (Biopsy) করা উচিত। এই অপারেশন দু’ভাবে করা যেতে পারে।

(১) Minimally Invasive Surgery বা চলতি কথায় মাইক্রোসার্জারি।

(২) Traditional বা ওপেন সার্জারি।

Minimally Invasive Surgery আবার দু’রকমের হয়। (এক) Laparoscopic (ল্যা পারোস্কোপিক) Surgery- এই পদ্ধতিতে রোগীকে অজ্ঞান করে পেটের চারটি অংশে চারটর ছিদ্র করা হয়। এই ছিদ্রের মাধ্যমে পেটের ভেতর একটি ছোট্ট ক্যাoমেরা এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্র ঢুকিয়ে দিয়ে পিত্তথলিটি বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। (দুই) Mini cholecystectomy (মিনি কোলেসিস্টেকটমি) এই পদ্ধতিতে পেটের ওপরের অংশে ৫০-৬০মিলিমিটার কাটতে হয় এবং কিছু প্রয়োজনীয় যন্ত্রের সাহায্যে পিত্তথলি বাইরে বের করে নিয়ে আসা হয়। এই পদ্ধতির একটি সুবিধা হলো যে এটি বিনা অজ্ঞানে অর্থাৎ শুধুমাত্র অবশ করেও (Regional Anaesthesia) করা যায়। এর ফলে যে সমস্ত রোগীকে অজ্ঞান করার অসুবিধা আছে যেমন হাঁপানি বা ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিসের কারণে শ্বাসকষ্ট হয় বা যাঁরা খুবই বয়স্ক তাঁদের ক্ষেত্রে অপারেশনের ঝুঁকি অনেকটই কমে যায়।

উপরোক্ত পদ্ধতিতে যেহেতু খুবই অল্প পরিমাণে চামড়া কাটা হয়, সেকারণে রোগী ২-৩ দিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারেন।

ওপেন সার্জারির পদ্ধতি অনেক বছর ধরেই পরীক্ষিত। মনে রাখতে হবে, যে কোনো কারণে Minimally Invasive Surgery করা না গেলে একমাত্র রাস্তাকিন্তু এই পদ্ধতি।

গল ব্লাডার অপারেশনের পর কী কী সমস্যা হতে পারে

সাধারণত সব অপারেশনেই সামান্য রক্তক্ষরণ বা জীবাণুর সংক্রমণের সম্ভাবনা সর্বজন স্বীকৃত।

পিত্তনালীতে পাথর থেকে যেতে পারে সন্দেহ থাকলে অপারেশন চলাকালীন Cholangiogram বা এক ধরনের পিত্তনালীর Xray করা হয়। সবচেয়ে ভালো হয় যদি কোলোডোকোস্কোপ ব্যবহার করা যায়। এটি একটি খুবই ছোট ক্যা মেরা যেটা অপারেশন চলাকানীন পিত্তনালীর ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে পিত্তনালীর অভ্যন্তরীণ অংশ দেখা হয়। নালীতে পাথর থাকলে প্রয়োজনমতো তা বের করেও ফেলা যায়। তবে ঘটনা এই যে, এই যন্ত্রের ব্যবহার খুব কম প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো গল ব্লাডার অপারেশনের সময় পিত্তনালী জখম হওয়া। তবে এই ধরনের সমস্যাা নিতান্তই হাতে গোনা। এই সমস্যায় দেখা দিলে খাদ্যনালীর খানিকটা অংশ ব্যবহার করে নতুন করে পিত্তনালী তৈরি করতে হয়। এই ধরনের জটিল অপারেশনের দরকার হলে কোনো বড় প্রতিষ্ঠানে অভিজ্ঞ সার্জেনের পরামর্শ নেওয়াই যুক্তিযুক্ত।

অপারেশনের পর বিধিনিষেধ

Minimally Invasive Surgery (মাইক্রোসার্জারি) হলে ১০-১৫দিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে কাজে ফেরা যায়।

অপারেশনের পরে রোগীর বাড়িতে একেবারে শুয়ে না থেকে সামান্য চলাফেরা করা ভালো, তাতে তাড়াতাড়ি সুস্থ হওয়া যায়। গল ব্লাডার অপারেশন হয়েছে বলে খাওয়া-দাওয়ার খুব একটা বাছবিচার করার প্রয়োজন নেই। তবে তেল, ঘি বা চর্বি জাতীয় খাবার কম খেলেই ভালো। কারণ কিছু না হোক কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইডের হাত থেকে আপনার হার্টকে রক্ষা করবে।

0 comments:

Post a Comment

Blog Archive

Recent Posts

Categories

Unordered List

Sample Text

Pages